কলাপাড়া(পটুয়াখালী)প্রতিনিধি।। সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির শাপলা। কয়েক বছর আগেও পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকার খাল-বিল ও পুকুরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকত হাজার হাজর শাপলা ফুল। রং-বেরংয়ের বাহারী রূপে শাপলা দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। এখন গ্রামের পর গ্রাম ঘুরলেও দেখা মিলছেনা আগের মতো সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। কালের বিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তন, আধুনিক কৃষিতে কীটনাশকের ব্যবহার, মানুষের প্রয়োজনে জলাশয় ও কৃষিজমি ভরাট করে বাড়ি ঘর নির্মাণের কারণে এ শাপলা প্রায়ই হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে এই শাপলার সংরক্ষণ বা গবেষণামূলক নেই কোনো কার্যক্রম। তাই সকল প্রকার শাপলার বংশ বিস্তারে সরকারী বেসরকারীভাবে ভূমিকা রাখা দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা।
তাদের ভাষ্যমতে উপকূলীয় এলাকায় লাল,সাদা, বেগুনি, হলুদ ও নীল এই পাঁচ ধরনের শাপলা রয়েছে। এদের মধ্যে সাদা শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল হিসেবে স্বীকৃত। নদীমাতৃক এ দেশে পূর্বে স্রোতবিহীন জলাশয়, পুকুর, খাল-বিলজুড়ে শাপলা ফুলে ছেয়ে থাকত। বিশেষ করে বর্ষা ও শরৎকাল ছিল শাপলার ফুল ফোটার মৌসুম। শাপলা শুধু সৌন্দর্য নয়, খাদ্য হিসেবেও গ্রামীণ জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করত। আবার অনেকে শাপলা তুলে স্থানীয় হাটে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তবে শাপলা ওষুধিগুণে সমৃদ্ধ বলে পরিচিতি রয়েছে। সাধারণ শাক-সবজির চেয়ে এর পুষ্টিগুণ বেশি। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমাণ আলুর চেয়ে সাতগুণ বেশি।
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, আগে যেসব জলাশয় শাপলা ফুল ফুটত, এখন সেই জায়গাগুলো এমশই ভরাট হয়ে গেছে। একই সাথে কৃষি জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারে এর বংশ বিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে কোথাও কোথাও গভীর জলাশয়ে কিছু লাল ও সাদা শাপলা দেখা গেলেও বেগুনি, নীল বা হলুদ শাপলার দেখা মেলে না বললেই চলে। গ্রামবাংলার চিরচেনা নয়নাভিরাম রূপ যেখানে বর্ষায় শাপলার সৌন্দর্য মানুষের মন জুড়িয়ে দিত তা এখন শুধুই স্মৃতি।
স্থানীয়রা জানান, এ উপজেলার গ্রামাঞ্চলের মাঠ, ডোবা-নালা ও খাল-পুকুরগুলো বৈশাখ মাসে পানিতে ভরে যেতে শুরু করে। এরপর তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে এসব জলাশয়ে ভরে যেত রং-বেরংয়ের বাহারী শাপলা ফুলে। নয়নাভিরাম এসব দৃশ্য উপভোগ করতো সব বয়সের মানুষ। কিন্তু চাষের জমিতে অধিক মাত্রায় আগাছা নাশক কীটনাশক প্রয়োগ করাসহ খাল-বিল ও আবদ্ধ জলাশয়গুলো দিন দিন শুকিয়ে যাওয়ার কারণে শাপলার শালুক নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে শাপলার বংশ বিস্তার বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে।
উপজেলা নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামে বাসিন্দা বিমল মৃধা বলেন, শাপলা পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি হওয়ায় এটিকে খাদ্য তালিকাতেও স্থান করে নিয়েছে অনেকে। এছাড়া এক সময় এ এলাকার মানুষ শাপলার ফল দিয়ে সুস্বাদু খৈ ভাজতো। কিন্তু এখন তোমন একটা দেখাই যায় না। বর্তমানে দেশে বাড়তি জনগণের চাপের কারণে আবাদী জমি ভরাট করে বাড়ি, পুকুর, মাছের ঘের বানানোর ফলে বিলের পরিমাণ কমে গেছে। যার ফলে শাপলা জন্মানোর জায়গাও কমে আসছে।
শিক্ষক মো.মোহাজ্জেম হোসেন জানান, শাপলা সাধারণত লাল ও সাদা রংয়েরই চোখে পড়ে। বর্ষা থেকে শীত পর্যন্ত বিল জলাশয় ও নিচু জমিতে প্রাকৃতিকভাবে এ শাপলা জন্মায়। এসব শাপলা খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি। তবে অযন্তে অবহেলায় এ উদ্ভিদ হারিয়ে যেতে বসেছে। সকল প্রকার শাপলার বংশ বিস্তারে সরকারী বেসরকারী ভ‚মিকা রাখা জরুরী।
পরিবেশ কর্মী মো.নজরুল ইসলাম বলেন, শাপলা হলো বাংলার একটি এতিহ্য। এক সময় খাল বিলে প্রচুর শাপলা দেখা যেতো। বর্ষা থেকে শীত পর্যন্ত বিল জলাশয় ও নিচু জমিতে প্রাকৃতিকভাবে এ শাপলা জন্মাতো। বর্তমানে চাষের জমিতে অধিক মাত্রায় আগাছা নাশক ও কীটনাশক প্রয়োগ করা ও নিচু জলাশায় জমি ভরাট করে বসতি স্থাপন করার কারণে শাপলার বংশ বিস্তার দিন দিন কমে যাচ্ছে।
পরিবেশবাদি সেচ্ছাসেবি সংগঠন প্রান্তজন’র ফিল্ড কোর্ডিনেটর মো.সাইফুল্লাহ মাহমুদ বলেন, শাপলার একটা গুণ হলো পানির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, জলজ পরিবেশকে বিশুদ্ধ করে এবং দূষণকারী পুষ্টি উপাদান শোষণ করে। এছাড়া শাপলার পাতা ও কান্ড জলজ পোকামাকড় ছোট মাছ ও অন্যন্য প্রানীর খাদ্যের উৎস হিসেব কাজ করে। এ শাপলা বিলুপ্ত হয়ে গেলে জলজ পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাই পরিবেশে ভারসাম্য রক্ষায় শাপলা বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
আপনার মতামত লিখুন :