অপূর্ব লাল সরকার, আগৈলঝাড়া (বরিশাল) থেকে : বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজাপুর শুটকি পল্ল¬ীর দেশী শুটকি এখন বিদেশেও রপ্তানী হচ্ছে। এখন চলছে শুটকির ভরা মৌসুম। প্রকৃতিক পরিবেশে স্বাস্থ্য সম্মতভাবে উৎপাদিত এই শুটকী পল্লীর শুটকির কদর রয়েছে দেশে ও বিদেশে। তবে আগের মত দেশী প্রজাতির মাছের স্বল্পতার কারণে হতাশায় ভুগছেন শুটকি পল্লীর সাথে জীবিকা নির্বাহ করা মৎস্যজীবি পরিবারগুলো। উপজেলার বাকাল ইউনিয়নের পশ্চিম সীমান্তবর্তী রাজাপুর গ্রাম। এই গ্রামের সাথেই ভৌগলিকভাবে জড়িত রয়েছে রামশীল, জহরেরকান্দি, ত্রিমুখী গ্রাম। রাজাপুর গ্রামের শুটকী ব্যবসায়ী অবনী রায় জানান, তিনি গত ১৮ বছর ধরে এই মৌসুমে শুটকির ব্যবসা করে আসছেন। রাজাপুর, রামশীল, জহরেরেকান্দি গ্রামসহ এ অঞ্চলের পাঁচ শতাধিক পরিবার শুটকি ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে। বিশেষ করে এক পাশে সন্ধ্যা নদী, অন্য পাশে কোটালীপাড়ার বিল এলাকার মধ্যবর্তী উপজেলার পয়সারহাট-ত্রিমুখী-রাজাপুর গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে শুটকি পল্লী।
বিলাঞ্চলের স্বাদু ও মিঠা পানির নানা প্রজাতির মাছের শুটকি দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানী করা হচ্ছে। কোন প্রকার রাসায়নিক বা কেমিক্যাল ব্যবহার না করায় শুধুমাত্র প্রকৃতির উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা শুটকি পল্লীর বিভিন্ন প্রজাতির দেশী মাছ ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট অঞ্চলসহ এখন ভারতেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে আগের তুলনায় দেশী ছোট পুটি, দেশী সরপুটি, পাবদা, কৈ, শৌল, টাকি, ভেটকি, খলিশা মাছসহ দেশী প্রজাতির অনেক মাছের সংখ্যা এখন ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। দু®প্রাপ্য হয়ে উঠেছে অনেক প্রজাতির দেশী মাছ। শুটকি পল্লীর সাথে জড়িত পরিবারগুলো মৌসুমী লাভের আশায় বছরের কার্তিক মাসের প্রথম থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত ছয় মাস এই পেশায় নিয়োজিত থাকে। এই শুটকি পল্লীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় চাহিদা রয়েছে সিধঁল শুটকির। যার প্রধান চাহিদা রয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে। সৌখিন ক্রেতারাও এই শুটকি পল্ল¬ী দেখতে এসে তাদের পছন্দ অনুযায়ী শুটকি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বাজার থেকে পাইকাররা এসে এখান থেকে মাছ কিনে নিয়ে যায়। আবার ঢাকার কাওরান বাজার, যাত্রাবাড়ি মোকামে গিয়েও পাইকারী মাছ বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। তবে অধিকাংশ ব্যবসায়ীরাই মহাজনের কাছ থেকে দাদন ও স্থানীয় বিভিন্ন মাধ্যমে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে শুটকির ব্যবসা করলেও মৌসুম শেষে ওই দাদন ও ঋণের টাকা পরিশোধ করে তাদের হাতে আর তেমন লাভ থাকেনা। মৌসুম শেষে তাদের জীবনে নেমে আসে হতাশা। স্থানীয়রা জানান, বিশ বছর পূর্বে ভৌগলিক পরিবেশের কারণে বানিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা পয়সারহাট-রাজাপুর-ত্রিমূখী শুটকি পল্ল¬ীতে দেশী প্রজাতির বিভিন্ন প্রকার মাছের মধ্যে পুঁটি, শৌল, টেংরা, খলিশা, পাবদা, কৈ, শিং, মাগুর, ভেটকি, টাকি, ফলি, বজুরী, বাইন মাছ অন্যতম।
এ শুটকি পল্ল¬ীতে দেশী প্রজাতির মাছগুলো আঁশ ছাড়িয়ে কেটে পানিতে পরিস্কার করে প্রাকৃতিক নিয়মে রোদে শুকিয়ে বিক্রির জন্য মজুদ করা হয়। এখানে ফরমালিনের মতো বিষাক্ত কোন রাসায়নিক দ্রব্য মাছে মেশানো হয়না। অবনী রায় আরও জানান, চাহিদার মধ্যে ক্রেতাদের প্রধান আকর্ষণ থাকে পুঁটি মাছের ওপর। প্রতি মন পুঁটি মাছ সাইজ ভেদে তাদের ক্রয় করতে হচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায়। প্রতি মন বাইন মাছের দাম আট থেকে ১০ হাজার টাকা, বুজরী চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা, যা এখন প্রায় পাওয়াই যায়না। শুটকি পল্লীর অপর ব্যবসায়ী মন্মথ রায়, অশোক রায়, নরেশ তালুকদার বলেন, বাজার থেকে একমন কাঁচা মাছ ক্রয় করে শুকালে ১৫-২০ কেজি শুটকি পাওয়া যায়। গড়ে প্রায় তিন মন কাঁচা মাছ শুকালে এক মন শুটকি পাওয়া যায়। এক মন পুঁটি মাছ শুটকি সাত থেকে আট হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। শুটকি পল্লীর মাছ কাটার কাজে নিয়োজিত রাজাপুর গ্রামের সন্ধ্যা অধিকারী, আয়না বেগম, পপি অধিকারী, শোভা রানী জানান, বছরে ছয় মাস মাছ কাটার সাথে তারা নিয়োজিত থাকলেও বাকি ছয়মাস কাটে তাদের অনাহারে-অর্ধাহারে। তারা বলেন, ছেলেমেয়েরা স্কুলে লেখাপড়া করছে। মাছ কেটে যা আয় করি তা দিয়ে বহুকষ্টে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। বর্তমানে শুকনা মৌসুমের শুরুতে মাছ বেশী পাওয়া গেলেও কার্তিক মাসের পর বিলে মাছ কম থাকায় তাদের দু:খ দুর্দশা আরো বেড়ে যায়। শুটকি ব্যবসায়ী রাজাপুরের অবনী রায় বলেন, সরকারীভাবে সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়ায় প্রতি বছরই তারা ঋণগ্রস্থ হয়ে পরছেন। তাই শুটকি পল্লীর সাথে জড়িত মৎস্যজীবিরা বছরের পর বছর সরকারের সংশ্লিষ্ট মৎস্য বিভাগের কাছে সহজ শর্তে ঋণ দাবি করে আসলেও বরাবরই তা উপেক্ষিত হয়ে আসছে।