সাইদুর রহমান: দেশ যে হারে সমৃদ্ধির পথে চলমান।সামাজের মানুষের নৈতিক অধঃপতন যদি অপ্রত্যাশিত ভাবে বৃদ্ধি পায়, তাহলে সমাজে ইজ্জত- সম্মান অথবা সামাজিক নিরাপত্তা সবই অসম্মানের দুর্গন্ধে সমাজ সংসার ঢেকে যাবে। নিরবে নিবৃত্তে আত্বচিৎকার করবে সমাজের লাজ্জিত মানুষ গুলো। যুগের তালে সমাজের অবক্ষয় অথবা সমাজের মানুষরূপী জানোয়ারদের অপকর্মের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে । ভিন্নতা আসছে ধর্ষণে, মাদকে, দুূর্নীতিতে, সামাজিক বিচারে । ধর্ষণের ব্যাপকতা বা নতুন মাত্রা দিচ্ছে ধর্ষণকারী।ধর্ষণকারীরা এ সমাজ সংসারের অশুভ শক্তি। ধর্ষণের নিষ্ঠুরতাই আজ সমাজের সবচেয়ে বড় ক্ষত হিসাবে স্হান পাচ্ছে। অবাল, বৃদ্ধা অথবা চকলেট খাওয়া শিশু থেকে শুরু করে পাঁচ সন্তানের জননীও ধর্ষণকারী নামক সমাজের কীটগুলোর বিকৃত যৌন হামলা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। অথচ সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীদের অবদান প্রশংসনীয়। অগগ্রতিতে তাদের অবদান বড় ভূমিকা রাখলেও ঘরের মধ্যে নারীর অবস্থা তেমন বদলায়নি।
ধর্ষণের দৌরাত্ম্যের দাবালনে বাংলার প্রতিটি পাড়া-মহল্লা আজ কম্পিত । মনে হচ্ছে সবুজ, শ্যামল দেশটা দিনে দিনে ধর্ষণকারীদের দাপটে অদৃশ্য হচ্ছে সমাজের মূল্যবোধ। পত্রিকা, মিডিয়া, কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে ধর্ষণের প্রতিদিনের খবরে নতুনত্ব পরিলক্ষিত হয়। যারা অতিৎসাহী হয়ে ধর্ষিতার ছবি সহ খবর প্রকাশ করে, তাদেরকে কাছে বিনীত অনুরোধ ” ধর্ষিতা নয়, ধর্ষকের ছবি প্রকাশে উৎসাহিত হই । ” মসজিদ, কওমি মাদ্রাসার কিছু আলেম নামের কলঙ্ক, তাদের অভিনব ফান্দে পরে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষা নিতে আসা মেয়েরা। এই আলেম নামক জালেমদের হাত থেকে মেয়ে অথবা ছেলে কেউ রেহাই পাচ্ছে না। মেয়েরা হচ্ছে ধর্ষিতা আর ছেলেরা হচ্ছে বলৎকার । এই সব জালেম আলেমদের বিরোদ্ধে আলেম সমাজের মুখ খোলা উচিৎ। সমাজ ধর্মীয় শিক্ষকদের কাছ থেকে ধর্ষণের মতো অধর্মীয় কাজ কোনদিন জাতি প্রত্যাশা করেনি। আবার গতানুগতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও ধর্ষণে পিছিয়ে নেই। শিক্ষাকে যারা ধর্ষণের টোপ হিসাবে ব্যবহার করে তাদের বিচার রাষ্ট্রীয় আইনের বাইরে এসে করতে হবে। প্রতিটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ বাক্স রাখতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিকে ঢেলে সাজাতে হবে।
বর্তমানে সভ্য সমাজে নতুন আরেকটি লিঙ্গের আর্বিভাব ঘটেছে । যার নাম বেজাত (ধর্ষক) লিঙ্গ। এই বেজাত লিঙ্গরা পৌরুষের রাজ মুকুট মাথায় নিয়ে পৃথিবীতে প্রবেশ করে। ধর্ষণ নামক সমাজের সবচেয়ে ঘৃণিত কাজটা করে, তাই তারা “বেজাত ” পুরুষ জাতের পরিচয়ে পরিচায়িত হওয়ার কোন অধিকার তাদের নেই। বেজাতদের আচারনে জাতি আজ হতবম্ব,কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে গেছে।
প্রশাসন বা রাষ্ট্র যদি মনে করে, “বেজাতরা ” ভিন্ন গ্রহ থেকে গ্রহান্নিত হয়েছে। এটা হবে জাতির জন্য হতাশা ব্যঞ্জক । বেজাতরা যুগে যুগে ছিল। হয়তো বা তাদের দেহ থেকে এখন অতি বেগুনী রশ্মি নিঃসরন হচ্ছে বেশী। এই নিঃসরনে নারীকুল মাঠে, ময়দানে, বাসে, ট্রাকে, ট্রেনে এমন কি মসজিদ, মাদ্রাসায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অথবা সিঁধকেটে কিংবা ঘরের দরজা ভেঙ্গে গণধর্ষণ মহাসমারোহে চলতেছে। বেজাতরা নিজের মেয়েকে পর্যন্ত ধর্ষণ করতে বিবেকে বাঁধেনা। বেজাতদেরকে আমরা পুরুষজাত থেকে ধিক্কারের সাথে বিতাড়িত করে দিতে চাই । বেজাতরা পুরুষ স্বরূপে দৃশ্যমান হতে পারবে না।কারন তাদের বক্ষ বিদির্ণ করে ” বেজাত ” চিহ্ন এঁকে দিব। এই বেজাতদের কোন দল, ধর্ম, বর্ণ, জাত, গোষ্ঠী মা, বোন নেই। সবাই আজ এদের কন্ঠনালি ছিন্ন করে, কন্ঠরোধ করতে বদ্ধ পরিকর।
ধর্ষকের বিকৃত যৌন আচারনে আমাদের নারী সমাজ আজ আতংকিত । ওরা সমাজের মারাত্মক ব্যধি । ওদের বিরোদ্ধে তীব্র সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ওদের অশুভ লম্বা অংশটুকু কুকুরের খাবারে শুভা পায়। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ শুধু রাষ্ট্রীয় গতানুগতিক আইন দিয়ে বিচার করে, সমাজকে ধর্ষণ মুক্ত করা সম্ভব নয় । সমাজের প্রতিটি মানুষের সাহায্য ও সহযোগীতা একান্ত দরকার।পাশাপাশি সামাজিক বিচার শালিশে ন্যায় বিচার অতন্ত্য জরুরী।
ধর্ষণ রোধে আইনের প্রয়োগের কঠোরতার পাশাপাশি চাই জড়ালো সামাজিক আন্দোলন। বর্তমানে সারা দেশে ২০ হাজারেরও বেশী ধর্ষণের মামলা বিচারাধীন। এই সব মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হবে। ধর্ষণকারীকে মানসিক ভাবে চাপে রাখার জন্য সমাজচ্যুত করা অতিজরুরী। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় যুবসমাজকে সম্পৃক্ত করে, ধর্ষণ প্রতিরোধ কমিটি করতে হবে। ধর্ষণকারির পরকালে কি রকম শাস্তি হতে পারে, তার বর্ননা মসজিদ, মন্দির, গির্জায় দিতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী একজন ধর্ষকের কি বিচার হতে পারে, তা পাঠ্যপুস্তকে অন্তরভুক্ত করাতে হবে। বিদেশী সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে। সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোন প্রকার অশ্লীল ছবি প্রদর্শন যাতে করতে না পারে, সেদিকে সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ধর্ষণের রাষ্ট্রীয় আইনের যথার্থ প্রয়োগ করতে হবে।
ধর্ষণের বিচারের চেয়ে ধর্ষণ প্রতিরোধ অতিজরুরী। প্রকাশিত ধর্ষিতাকে সমাজ কলঙ্কের দায়মুক্তি সহজে দেয় না। পরবর্তী প্রজন্মান্তরও এর দায়ভার এড়াতে পারেনা। ধর্ষণের পর ধর্ষিতা ও ধর্ষিতার পরিবারের সামাজিক অবস্হা মাটিতে মিশে যায়। সমাজের কেউ তাদেরকে প্রকাশ্যে ঘৃণার বৃদ্ধা আঙ্গুলী দেখায়, কেউ আবার ধর্ষিতার পরিবারেকে সমাজচ্যুত করার জন্য চক্রান্তের জাল বিস্তার করে। ধর্ষিতা ও ধর্ষিতার পরিবারকে যুগের পর যুগ ধরে ধর্ষণের অপবাদ সইতে হয়। ধর্ষকের হয়তোবা রাষ্ট্রের আইনানুযায়ী সর্বোউচ্চ বিচার হবে কিন্তু তার পরিবার কিংবা পরবর্তী প্রজন্মকে এ দায়ভার বহন করতে হবে।
প্রকাশিতব্য ধর্ষণের চেয়ে অপ্রকাশিতব্য ধর্ষণ অনেক বেশী। এটা রাষ্ট্র কিংবা সমাজ অস্বীকার করতে পারবেনা । সমাজ, সংসার, লোক লজ্জার ভয়ে বেশী সংখ্যক নারীরাই, নারীকুলের সর্বস্ব হারানোর কথা স্বীকার করেনা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নির্যাতনের শিকার নারীদের মধ্যে কেবল ১ দশমিক ১ শতাংশ পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। যারা অভিযোগ করেন, তাদের মধ্যে মাত্র ৩ দশমিক ১ শতাংশ নারী নিজের পক্ষে বিচার পান। বাকি ৯৬ দশমিক ৯ শতাংশ অভিযোগ আদালতে খারিজ হয়ে যায়; অনেক ক্ষেত্রে শুনানিও করা হয় না। ধর্ষণের মতো এতবড় মানসিক চাপ সব নারী নিতে পারেনা। যারা চাপ সইতে পারেনা তারা কেউ আত্বহত্যার মতো জঘন্যতম কাজটা করে, কেউ আবার পাগলের খাতায় নাম লেখায়। অবশিষ্টরা জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকে। তাই পরিসংখ্যা এখানে কতটুকু সত্যতা দিতে পাবরে, তা পরিস্কার। তারপরও গত বছরের ধর্ষণের পরিসংখ্যাকে এ বছর ৬ মাসেই অ- নে- ক বেশী পিছনে ফেলে রাষ্ট্র ও সমাজকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের এক গবেষণায় ২০১৮ সালে সারা বছরে ২৫১জন নারী ধর্ষিত হয়েছিল। এ বছর আশঙ্কাজনক হারে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ছয় মাসে ধর্ষণ ৬৩০ টির বেশী নারী ধর্ষিত হয়েছে। আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৭ জনকে। ধর্ষণের নির্মম যন্ত্রণা সইতে না পরে আত্বহত্যা করেছে ৭ জন। প্রতি মাসে গড়ে ১০০ জনের বেশী নারী ধর্ষিত হচ্ছে। বর্তমানে ধর্ষণের পর হত্যার সংখ্যা অপ্রত্যাশীত ভাবে বেড়ে গেছে। এর জন্য রাষ্ট্র ও সমাজকে নতুন করে ভাবতে হবে।
নারীর প্রতি আমার আবেদন,
“আপনারা পোশাকে আধুনিক না হয়ে, মনে এবং মানসিকতায় আধুনি
হবেন ”
লেখক ও কলামিস্ট।